রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

জনতা আর ক্ষমতার দুই মেরু

এম আর ইসলাম:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অঙ্কুরিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনের শহীদরা বা ছাত্র নেতৃত্বে ছিলেন বেশির ভাগই দরিদ্র আর নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ এর নির্বাচন, তদানীন্তন সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন, ছয় দফা ভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ, প্রায় সবকটা আন্দোলনের নেতৃত্ব, সক্রিয় সংগঠক ও অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই সেই সময় এসেছিলেন সাধারণ অসচ্ছল পরিবারগুলো থেকেই। বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় আর আঞ্চলিক নেতৃত্বের প্রায় সবাই ছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি। তাই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই ছিল গরিব মানুষ। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের আরকাইভাল রেকর্ড তাই বলে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের শ্রোতাদের একটু খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যাবে তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ছাপোষা নিম্নআয়ের মানুষ। তখন তাই সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দূরত্ব ছিল না। সাধারণ মানুষের যেকোনো কষ্ট, দুর্দশা রাজনৈতিক নেতৃত্বদের ছুঁয়ে যেত নৈতিক ও বাস্তবিক ভাবে। তখন সাধারণ মানুষের বাড়িতে বাজার না থাকলে, রাজনৈতিক নেতার বাড়িতেও বাজার না থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। তখন তেলের দাম এক টাকা বাড়লে, সাধারণ মানুষের মতো রাজনীতিকদের ঘুমও হারাম হতো। গরিবের সমস্যাই তখন জাতীয় সমস্যার মর্যাদা পেত। রাজনীতি তখন ছিল দেশের জন্য, গণমানুষের জন্য। ব্যক্তিগত লোভ আর পারিবারিক স্বার্থ উদ্ধার রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল না সে জামানায়।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আশির দশক থেকে রাজনীতিতে নতুন পরিবর্তন আসা শুরু হয়। রাজনীতিও তখন দরিদ্র আর নিম্নবিত্তদের হাত থেকে মধ্যবিত্তদের হাতে যাওয়া শুরু করে। এর পেছনে কারণও ছিল। দেশ যেহেতু স্বাধীন হয়েছিল, তখন রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে সবসময়য় অর্থনৈতিক মাথাব্যথার কারণ হিসেবে খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। ৯০-এর স্বৈরাচার পতনের গণআন্দোলন, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন, এ সবই ছিল মধ্যবিত্ত নেতা ও কর্মীদের আন্দোলন মূলত। দেশ ও সমাজ নিয়ে আন্তরিকভাবে ভাবার লোক ছিল অনেক। রাজনীতি তখনো পর্যন্ত প্রকৃত বুদ্ধিজীবী আর উদারমনাদের সংস্পর্শে ছিল। জাতীয় পর্যায়ের জোচ্চুরিগুলো নির্লজ্জভাবে করার সাহস তখনো কেউ দেখাত না। এদেশের রাজনীতিবিদরা তখনো বুর্জোয়া রাজনীতির দিকে খুব একটা ভেড়েননি। কেউ কেউ অবশ্য এরশাদ সরকারের আমল থেকে রাজনীতির প্রদীপ পাওয়ার মতো, অর্থনৈতিক দৈত্যও লাভ করেছিল বটে, কিন্তু সেটা পাইকারি হারে তখনো শুরু হয়নি। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও মানবিক গুণাবলি তখনো পর্যন্ত পুঁজিবাদী রাজনীতির সর্বগ্রাসী ছোবলে বিষাক্ত হয়নি। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে রাজনীতি উল্টোপথে হাঁটা শুরু করে।

একবিংশ শতাব্দী দেখল আর দেখাল রাজনীতির হাত থেকে আসলে কিছুই রেহাই পায় না। রাজনীতি হয়ে উঠল অবৈধ অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। নৈতিকতা আর আদর্শের রাজনীতি হয়ে গেল নির্বাসিত। কোটি টাকা, শতকোটি টাকা, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিকদের নাম আসা শুরু করল। রাজনৈতিক হেডকোয়ার্টারগুলো দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠল কালক্রমে। মাস্তান, চাঁদাবাজ, আন্ডারগ্রাউন্ডের ডাকাত, ভবঘুরে ধাপ্পাবাজ, অশিক্ষিত জুলুমবাজ, চশমখোর ব্যবসায়ী সবাই রাজনীতির প্রত্যক্ষ শেলটার নেওয়া শুরু করল। রাজনীতি হয়ে উঠল আখের গোছানোর হাতিয়ার। এমপি, মন্ত্রী থেকে শুরু করল অনেকেই যাদের জাতীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক অবদান ছিল শূন্য। মানুষের অবাক হওয়ার পালা শুরু হলো। রাজনীতির এই অমৃত স্বাদ যে পেল, সে আর রাজনীতির কোনো পদ-পদবিই ছাড়তে চাইল না। এদেশের রাজনীতি ধীরে ধীরে রাজতন্ত্রে পরিণত হতে থাকল। ব্যবসায়ীরা রাজনীতির কলকাঠি নাড়া শুরু করল। এদের অবশ্য ব্যবসায়ী না বলে, বেনিয়া বলাই শ্রেয়। এরা রাজনীতিবিদদেরও প্রভাবিত করতে থাকল পুরোদমে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটাই হয়ে উঠল ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট।

একবিংশ সালের প্রথম দিক থেকেই মানুষ দেখতে শুরু করে কাঁচা মরিচের দাম দুইশ টাকা। বেগুনের দাম একশ টাকা। সিন্ডিকেট করে, সাময়িক সময়ের মধ্যেই হাজার কোটি টাকা বানানোর কারসাজি শুরু হয়ে যায়। তারই পরম্পরায় আজ তেল, সবজি, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। দ্রব্যমূল্য আর তার কারণে জনবিপর্যয় আজ রাজনীতিকদের আর খুব একটা স্পর্শ করে না। বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, তাজউদ্দীনদের আদর্শ-বিচ্যুত হাল জামানার রাজনীতিকরা আজ আর সাধারণ মানুষের কাতারে নেই। প্রাডো গাড়ি, বনানীর বাড়ি, আর রোলেক্স ঘড়ির রাজনীতিকদের জন্য দ্রব্যমূল্য কোনো মাথাব্যথা নয়। তাদের বড় মাথা, বড় প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি আজ সাধারণ মানুষকে শোনায় সংখ্যার পরিসংখ্যন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার টিসিবির গাড়ির পেছনের ছোটা তো আর রাজনীতিকদের করতে হয় না।

জনসাধারণ বা জনতা আর ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা আজ দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের নাম পর্যন্ত কেউ নিতে চায় না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও আরোপিত হয় না। মাঝে মাঝে কিছু ব্যবসায়ীকে আর্থিক জরিমানা করা হয় বটে, তবে তা তাদের মুনাফার অঙ্কের কাছে নস্যি। কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দুই দিন অন্তর অন্তর কারণে অকারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, তার কোনো রাজনৈতিক বা আইনি প্রতিষেধক তৈরি হলো না। নিম্নআয়ের মানুষসহ মধ্যবিত্তরা যাদের আমরা ‘সাধারণ জনগণ’ বলি তাদের আছে শুধু হা-হুতাশ। তারা জানে না কীভাবে তাদের পরিত্রাণ। যে কোনো গণতন্ত্রে রাজনীতিকরা হয়ে থাকে পাবলিক এজেন্ট। অনেক কিছুর মতোই, জনগণের আজ এজেন্সি সংকট। সাংবিধানিকভাবে সমাজতন্ত্রের বাংলাদেশ আজ চূড়ান্ত পুঁজিবাদী আর বুর্জোয়া পলিটিক্সের শিকার। দ্রব্যমূল্যের বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারের নেওয়া এক কোটি মানুষের জন্য বরাদ্দ সাশ্রয়ী মূল্যের ব্যবস্থা নিয়েও মানুষ আজ দ্বিধাদ্বন্দ্বে। জুটবে তো রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা তার কপালে? সামনের রোজার মাসের সাহরি আর ইফতার (দুবেলা খাবারের) এর নিশ্চয়তা খুঁজে চলে তাই সাধারণ মানুষেরা। সর্বগ্রাসী রাজনীতির জামানায়, অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষের আজ বেঁচে থাকাটাই অনন্ত সংগ্রামের।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION